রাজধানীতে গতকাল বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত টানা সাত ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকায় স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। সড়কে যানজটের চিরচেনা রূপ ফিরে আসে। ছিল কর্মব্যস্ত মানুষের পদচারণ। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও গতকাল টানা কয়েক ঘণ্টা কারফিউ শিথিল ছিল।
কারফিউ শিথিল থাকার সময় রাজধানীর সড়কগুলোতে যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ ছিল। অনেক স্থানে তীব্র যানজট দেখা দেয়। টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সীমিত সময়ের জন্য খুলেছে। ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের ভিড় দেখা যায়।
শিল্প-কারখানাগুলো গতকাল উৎপাদনে ফিরে এসেছে। গাজীপুরের সব পোশাক কারখানায় কর্মীদের কাজে ফিরতে দেখা গেছে।
কারফিউয়ের কারণে ঢাকায় আটকে পড়া যাত্রীদের পরিবহনে গতকাল দূরপাল্লায় বাস চলেছে। তবে ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
আজ থেকে সীমিত পরিসরে ট্রেন চলাচল শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। শুরুতে আন্ত নগর ট্রেন চালানো হবে না। শুধু লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলবে। যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও মালবাহী ও তেলবাহী ট্রেন চলাচল চালু আছে। পুলিশি পাহারায় এসব ট্রেন চলাচল করছে।
জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, কারফিউ শিথিলের সময়টাতে যাত্রীবাহী কিছু ট্রেন কাল (আজ) থেকে চালানো হবে। স্বল্প দূরত্বের লোকাল-কমিউটার ট্রেন চলবে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। শুরুতে বৃহস্পতিবার ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-টাঙ্গাইলসহ দেশের আরো বেশ কিছু রুটে ট্রেন চলবে। কাল শুক্রবার থেকে আন্ত নগর ট্রেন চালু হতে পারে।
গতকাল সকাল ১০টা থেকে গাবতলী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে গেছে। এ সময় বাস মালিকরা জানান, রাজধানী থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যাবে। লঞ্চের বিষয়ে যাত্রী না পাওয়ার শঙ্কা করছেন মালিকরা। তবে কারফিউ শিথিলের সময়টাতে লঞ্চ চালানো যাবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)। কিন্তু বেশির ভাগ লঞ্চ সকাল বা সন্ধ্যার পর ঢাকার প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। কারফিউ শিথিলের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে লঞ্চ ছাড়বে কি না, মালিকরা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
ঢাকার সড়কে তীব্র যানজট
গতকাল মাত্র চার ঘণ্টার জন্য অফিস খোলে। কারফিউ শিথিল থাকে সাত ঘণ্টা। এতে কর্মজীবী মানুষসহ জরুরি প্রয়োজনে সবাই ঘর থেকে বের হয়েছে। একসঙ্গে সড়কে প্রচুর গাড়ি নামায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ধানমণ্ডি ২৭, বিজয় সরণি, মহাখালী ও বনানী এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
জিগাতলা থেকে নিজ মোটরসাইকেলে বনানী এসেছেন রাজীব আহাম্মেদ। বাসা থেকে ১১টা ৪০ মিনিটে বের হয়ে পৌঁছেছেন পৌনে ১টায়। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। ভেবেছিলাম ১০ মিনিটে চলে আসব। কিন্তু প্রতিটি সিগন্যালে ১০-১৫ মিনিট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর থেকে মিরপুর রোডে গাড়ির চাপ অনেক বেশি। বিজয় সরণিকে কেন্দ্র করে খামারবাড়ি, তেজগাঁও ও আগারগাঁওয়ে সড়কে গাড়ির ব্যাপক চাপ লক্ষ করা গেছে। গতকাল দুপুরে সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি গণপরিবহনও চলেছে স্বাভাবিকভাবে।
দুপুর আড়াইটার দিকে খিলক্ষেত থেকে রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী ও বনানীমুখী সড়কে যাত্রীর অপেক্ষায় বাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
পাঁচ দিন পর খুলল সচিবালয়
টানা পাঁচ দিন পর গতকাল চার ঘণ্টার জন্য খোলে সরকারের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। তবে সচিবালয়ে প্রবেশে ব্যাপক তল্লাশি করা হয়। অন্যান্য সময়ের তুলনায় নিরাপত্তাব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। সচিবালয়ের সামনে সেনা সদস্য মোতায়েন রয়েছে। প্রবেশ ফটকে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গাড়ি ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি কম লক্ষ করা গেছে।
গতকাল সচিবালয়ে দুপুর ১২টার মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ঘুরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাভাবিক উপস্থিতি দেখা গেছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. ইফতেখার হোসেন বলেন, ‘পাঁচ দিন পর অফিস করছি। তবে এই কদিন আমাদের কার্যক্রম থেমে থাকেনি। আজ রাস্তায় যানজট দেখা গেছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষ বেরিয়েছে।’
ব্যাংকে গ্রাহকের ভিড়
ব্যাংক খোলায় গতকাল টাকা তোলার চাপ বেড়েছে রাজধানীর ব্যাংকগুলোতে। এটিএম বুথেও অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ভিড় দেখা গেছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণার কারণে টানা তিন দিন বন্ধ ছিল দেশের ব্যাংকগুলো। লেনদেনসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ সময় ইন্টারনেটসেবা বন্ধ থাকায় ডিজিটাল ও মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা কার্যক্রমও ব্যাহত হয়। এ কারণে আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে।
সকাল ১১টা থেকে লেনদেন শুরু হয়ে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে। এ সময় ব্যাংকগুলোতে সীমিত পরিসরে সেবা দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ব্যাংকে অর্থ লেনদেন ছাড়া অন্য কোনো কার্যক্রম তেমন হয়নি। এতে টাকা জমা দেওয়া ও উত্তোলনের কাউন্টারে গ্রাহকের ভিড় থাকলেও অন্যান্য কাউন্টার ছিল অনেকটা ফাঁকা। পে অর্ডার, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পেরে ভোগান্তিতে পড়েন অনেক গ্রাহক। গতকাল রাজধানীর ব্যাংকপাড়া মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
দুপুর ১২টার দিকে মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে দেখা যায়, টাকা জমা ও উত্তোলন কাউন্টারের সামনে গ্রাহক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যান্য কাউন্টার প্রায় ফাঁকা।
সোনালী ব্যাংকে টাকা তুলতে আসা আমিনুল নামের এক গ্রাহক বলেন, ‘একটি পে অর্ডার ছিল, ক্লিয়ারিং হয়নি। পাইকারি পণ্য বিক্রি করি। গত কয়েক দিন টাকা দিতে না পারায় মাল আটকা পড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে টাকা তুললাম।’
মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের জেনারেল ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আজ তিন দিন পর ব্যাংক খুলেছে। লেনদেন যে অনেক বেশি ছিল, উপচে পড়া ভিড়—তা নয়। এলসি হয়নি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সেবাগুলোও দেওয়া যায়নি।’
নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘নেট পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলে এলসি হবে কিভাবে। সাত দিন আগে তিনটি এলসি দিয়ে রেখেছি, একটাও ওপেন হয়নি।’
স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরেছে শিল্প-কারখানা
দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক শিল্পসহ উৎপাদনমুখী কারখানাগুলো গতকাল খুলেছে। এতে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছেন শ্রমিকরা। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রায় শতভাগ কারখানা কাল উৎপাদনে এসেছে।
এ ব্যাপারে বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে দেশের শিল্পাঞ্চলগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। শ্রমিকরাও তাঁদের শৃঙ্খল জীবনে ফিরতে পেরে খুশি।
শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি কালের কণ্ঠকে বলেন, বেশির ভাগ শ্রমিক কারখানা আশপাশে থাকায় প্রায় শতভাগ শ্রমিকের উপস্থিতি রয়েছে কারখানাগুলোতে।
শিল্প পুলিশের এআইজি মো. মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই দেশের প্রায় সব কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছে। কোথাও কোনো সংকট হয়নি।
বিজিএমইএর পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন কালের কণ্ঠকে বলেন, কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রাণ ফিরে এসেছে দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে। শ্রমিকদের উপস্থিতির হারও বেশ ভালো।
গাজীপুরের পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য
নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর জানান, গাজীপুরের পোশাক কারখানাগুলো গতকাল খুলে দেওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের উপস্থিতিতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে।
গাজীপুর আলেমা টেক্সটাইলের শ্রমিক কুলসুম আক্তার জানান, গত বৃহস্পতিবার কারখানা কর্তৃপক্ষ বেতন দিয়েছে। মোবাইল ফোনে বিকাশের মাধ্যমে টাকা এলেও গত শনিবার থেকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় টাকা তুলতে পারেননি। ঘরে বাজারের টাকাও ছিল না। বাসাভাড়াও পরিশোধ করতে পারেননি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় সব সমস্যা দূর হবে বলে আশা করছেন তিনি।
কোজিমা লিরিক গার্মেন্টের শ্রমিক বিল্লাল হোসেন বলেন, তিন দিন বাসায় অলস সময় পার করেছেন। কারখানা খুলে দেওয়ায় ভালো লাগছে।
গাজীপুরে প্রিন্ট নেটওয়ার্ক কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসান সোহেল বলেন, সকালে কারখানা খুললেও হাতে তেমন কাজ নেই। নতুন কোনো অর্ডারও নেই। নতুন অর্ডার পাওয়ার পর স্বাভাবিক উৎপাদনে যেতে কয়েক দিন সময় লাগতে পারে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে।