রবিবার , ২৯ জুন ২০২৫ | ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ
  3. অর্থনীতি
  4. আইটি বিশ্ব
  5. আইন-বিচার
  6. আন্তর্জাতিক
  7. ইসলাম
  8. ঈদুল ফিতর
  9. ক্যাম্পাস
  10. ক্রিকেট
  11. খুলনা
  12. খেলা-ধুলা
  13. চট্টগ্রাম
  14. জাতীয়
  15. ঢাকা

সুলতানের চোখে আর রঙে বাংলাদেশ”

প্রতিবেদক
স্বাধীন কাগজ
জুন ২৯, ২০২৫ ১২:০৩ অপরাহ্ণ   প্রিন্ট সংস্করণ

কলমেঃ মোঃরফিকুল ইসলাম
লেখাটি সংগ্রহ করেন খুলনা থেকে চিত্রশিল্পী মিলন বিশ্বাস।

বৈশিষ্ট্য তথা বিচিত্রতায় শিল্পীর মধ্যে শিল্পীর প্রকারভেদ রয়েছে।বাউণ্ডুলে স্বভাবের হলেও তার শান্তস্বর, কর্ম স্থিরতা বিরল।পরিবেশ,পরিস্থিতি ছবি আঁকার অনুকূলে।কিন্তু,অকালে মাতৃবিয়োগ গৃহত্যাগী বাসনা জাগিয়ে তুলছে।সম্ভবত আমি পড়েছি-অবহেলিত কোনো টুকরো কাগজের ভাঁজে।’ নারী পুরুষ একে অপরকে ভালোবাসলে নারী হয়ে যায় নদী আর পুরুষরা হয় জলন্ত কাঠ।মানুষ মনের অজান্তে প্রেমে পড়ে বা ভালোবাসায় জড়িয়ে যায়।এখানে মানুষেমানুষের কোনো নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ নেই।
উপেক্ষা নাকি অপেক্ষা কোনটা শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য! মূলতঃ এই ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে আজকে এই লেখাটাতে হাত দিয়েছি।
আর্থিক দৈন্য, নিঃসঙ্গতা, প্রতিভার অস্বীকৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বললে অসংখ্য যুক্তি তর্কে শিল্পীর পক্ষে কথা বলতে পারবো।কিন্তু,আলোচনার শিল্পী কে,সেটা এতোক্ষণেও বলা হয়নি।সুপ্রিয় পাঠক, নামধারী নামে নয়, অন্য নামে তিনি অধিক পরিচিতি পেয়েছেন।হারিয়ে গেছে পারিবার হতে রাখা ডাকনাম,লাল মিয়া।শাহেদ সোহরাওয়ার্দী (হোসেন সোহরাওয়ার্দীর বড় ভাই)শেখ মোহাম্মদ মেছের আলীর পুত্র, শিল্পী এস এম সুলতানের নতুন নামকরণ করলেন।তাঁর র্জীবনবৃত্তান্ত কিংবা শিল্পকর্ম নিয়ে বিস্তৃত বলার ধৃষ্টতা আমার নেই।বিভিন্নভাবে বিশ্লেষকগণ শিল্পীকে নিয়ে ও তার শিল্পকর্মের ওপর আলোকপাত করেছেন।আমি সাধারণ জ্ঞানে যতটা বুঝি-যিনি-পিকাসো,ভ্যান গঁগ,দালি,মাতিসের মতন খ্যাত শিল্পীদের সাথে যার প্রদর্শনী করার যোগ্য হয়েছেন, তিনি সর্বক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে গর্বের সহিত ধরে রেখেছেন,এস এম সুলতান।আর শুধু ধরে রেখেছেন বললে কম বলা হবে বরং, এভাবে বলা সমীচীন হবে- বাংগালীয়ানাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন,নিজস্ব স্টাইলে আঁকা শিল্প কর্ম ভিন্ন উপস্থাপন ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।নিয়ম কানুনের জটাজাল তিনি ছিন্ন করেছেন-ধ্যানে ও কর্মে।
১৯২৩ সালের ১০ আগষ্ট নড়াইল মহকুমার শহর সংলগ্ন মাছিমদিয়া গ্রামের সামান্য রাজমিস্ত্রী মেছের আলী পিতা ও তার স্ত্রী মেহেরুন নেছা বামাজু বিবির ঘরে একমাত্র সন্তান এস এম সুলতানের জন্ম ।মানুষের ইচ্ছা,স্বপ্ন এবং শ্রম সমস্ত বাধাকে পরাজিত করে।বাবার হাত ধরে তার কাজের সহযোগীতা করতে জমিদার বাড়িতে পা ফেলে সুলতান।আশ্চর্যজনক চোখে তাকিয়ে দেখে নকশায় ঝলমলে আশপাশ।বাংলার ঋতু রূপ বদলায় যেমন করে তেমনি বোধহয়,অদৃশ্য অন্তরের দহনে পুড়তে জানলে,ক্রমশ পথের সন্ধান মেলে।নড়াইলের তৎকালীন জমিদার ডি এল রায়।জমিদারের বড় ভাইয়ের ছেলে অরুণ রায় তখন কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র।শিল্পী সুলতানের আঁকতে মূলত এই অরুণ রায়-ই প্রথম গুরু।অন্তরের তাগিদে গুরুর পর গুরুর সহচরী হওয়াটা নতুন কিছু নয়।
শিল্পী সুলতানের ক্ষেত্রে ১৯৩৩ অর্থাৎ, যখন সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তখন বিস্মিত করার মতন সুযোগ সৃষ্টি হয়- সুলতানের জীবনে।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি সি শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ পরিদর্শনে আসেন।সকলের অনুরোধে হুবহু আকৃতি এঁকে অবাক এবং খুশি করে দিলেন।
জমিদারী আমলে অর্থ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।অর্থের সাথে সৃজনশীল মননের সম্পর্ক নেই।ডি এল রায় জমিদার হিসেবে কেমন ছিলেন খুব বেশি জানা নেই।তবে খুলনায় বসবাসকারী একজন নূন্যতম বাসিন্দা হয়ে জানি,উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি,নাট্য অঙ্গনের সমঝদার পৃষ্ঠপোষকতা।উদাহরণ টানা যায়,নাট্য নিকেতনের নাম।উনি,উদার হৃদয়ে কিছু ভালো কাজ করেছেন নিঃসন্দেহে যা প্রশংসনীয়।
যে কথায় ছিলাম,সেদিকে ফিরি।শিল্পী এস এম সুলতানের মুখে শোনা…
আমার ছবিতে শুধুই গ্রাম।বাংগালী চরিত্র-ই গ্রাম থেকে উঠে আসা।আমার চোখে দালান কোঠা,গাড়ি,যন্ত্রপাতি, কলকারখানা ওসব ধরা পড়ে না।আমি শুধু মানুষ দেখি।গ্রামের মানুষ।এরাই আমাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কাজেই, এদের বাহিরে আমার কোনো ভাবনা মাথায় আসে না।ধনী লোকদের সীমাহীন লোভ আর স্বার্থপরতা সব সামাজিক সমস্যার কারণ। লক্ষ্য করে দেখুন আদি যুগ থেকে কৃষক পৃথিবীর সকল মানুষের খাওয়াবার মতন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নেয় তারা কখনো আবারও বলছি,তারা দুর্বল হতে পারে না।তাই পেশিবহুল শারীরিক গঠনে আমার ছবি কথা বলে।
আমেরিকা,শিকাগো,ওয়াশিংটন, বোস্টন, মিশিগান,করাচী,সিমলায় একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে শিল্পীর।সুপ্রিয় পাঠক, কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে পয়তাল্লিশটি দেশ হতে আসা পয়তাল্লিশ জন শিল্পী।একজন( নারী মডেল) মাত্র পাঁচ মিনিট স্টাইল করে দাঁড়িয়ে থাকবেন।নিঁখুত এক্সপ্রেশনের ছবি যে শিল্পী আঁকতে পারবেন, সেই দেশ প্রথম হবে। এই প্রতিযোগিতায় সুলতান প্রথম আর সুলতান বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
শিল্পী সুলতান সেই ব্যক্তি যিনি বিশ্ব শান্তির জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্য ছিলো, অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা বাদ দিন।বরং সেই অস্ত্রের জন্য বরাদ্দ অর্থ দারিদ্র শিশুদের নিরাপদ খাদ্য শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয় করা হোক।অপুষ্টিতে, অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু আমাদের বিবেকের অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত।সুলতানের ছবির বিষয়, রঙ,মাত্রা, শৈল্পিকতায় মুগ্ধতা সহসা ধরা দেবেই!আমেরিকার মতো দেশের নাগরিকত্ব নিতে কতিপয় শিল্পমনারা তাকে বহু অনুনয়-বিনয় করেছেন কিন্তু, তিনি অকপটে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।প্রকৃত দেশপ্রেম শব্দটা তার সাথে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার এস এম সুলতান -কে ‘ ম্যান অব্ দ্য এচিভমেন্ট সম্মান জনক খেতাবে ভূষিত করেছে।দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক অর্জন করেছেন।শিল্পকলা একাডেমি তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।জার্মান কালচারাল সেন্টার একক চিত্র প্রদর্শনী করতে পেরে ধন্য হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স’ ঘোষণা করে সম্মানীও দিয়েছে।নিজ জেলা নড়াইলে বাদেও আমাদের খুলনাতে ১৯৬৯ সালে প্রেসক্লাবে একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে।ইতিপূর্বে উল্লেখ করা কথার জের ধরে প্রশ্ন করতেই পারেন যে, শিল্পীকে এতোটা মর্যাদায় আসীন করা হয়েছে তিনি অবহেলিত ছিলেন বলাটা স্ববিরোধী নয় কী! তারপরও বলবো ‘না’।আমার লেখাতে এদিকটায় আসছি,একটু পরে। ক্যানভাসে ‘আঁকা সবাক ইতিহাস’ – শিরোনামের ছবিটায় সত্যিকারার্থে, আমাদের স্বাধীনতার আসল ইতিহাস এবং দলিল।লেখক ঋষি এস্তেবান ‘ চিত্রভাষা বর্ণভাষা,সাহিত্য ও শিল্পবাজার’গ্রন্থে তার ছবির প্রসঙ্গে বলেছেন,”মাছ ধরা,কাজের খোঁজে, মলন মলা,গ্রামের হাট,ধান ঝাড়া,জমি কর্ষণ, গ্রামীণ জীবন, পুকুর ঘাটে স্নান,মাছ কাটা,ধান ভানা,পাট ধোয়া,লাঙ্গলের পিছে এরূপ অসংখ্য ছবির আলোচনা করতে হাজার হাজার পাতা লিখলেও শেষ হবার নয়।১৯৭১ সাল ‘ – এবং একটা ক্যানভাস। পুড়ছে গ্রাম। দিগন্ত জুড়ে লাফিয়ে উঠছে আগুন। বিষাদময় কালো ধোঁয়ায় ভরে আছে আকাশ।নারী, বৃদ্ধ, শিশুদের হাতটা ধরে এগিয়ে নেওয়া।সংসারের টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস, পোশা প্রাণী ছাগল, কুকুর।কয়েকজন যুবক শক্তিহীন বৃদ্ধকে ঢুলিতে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।বৃদ্ধার চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে ক্রোধ আর ঘৃণা।অন্যদিকে, দেশীয় অস্ত্র শড়কি, ঢাল বল্লম, রাম দা হাতে ফসলের মাঠ হতে অসীম সাহসী প্রতিজ্ঞায় শত্রুর মোকাবিলায় শত- হাজার- লক্ষ মানুষ যারা সাধারণ… সত্যি বলতে -এই ছবির ব্যাখা’ না লেখায়, না আঁকায়,না চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত করা যায়” !
শিল্পীর ভাগ্য মেখে সমাজে অহরহ কিছু মানুষ থাকে যারা উপেক্ষা করে, কুৎসা ঘটনা-রটনার ঘন্টা বাজানোর কাজ নেয়।নেপথ্যে কিছু মানুষ বরাবরই থাকে যা- নতুন কিছু নয়।সুলতানের ক্ষেত্রে এটা আরও জলন্ত।আমি ১৯৮৪ সালে পিতার সরকারি চাকুরীজনিত কারণে নড়াইলে তিন/মাস খুব ঘনঘন শিল্পীর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছে।তাঁকে দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া নিহারবালার সাথেও কথা হতো।চা-নাস্তা,খাওয়া, অবসর,মেজাজ মর্জি,মনোবেদনা, এককথায় শিল্পীর সাথে অনেকটা অতিবাহিত হয়েছে সময়।একটা সাদাকালো ১৪/১৭” টিভি ছিলো, শিল্পীর ঘরে। মাঝেমধ্যে খবর শুনতেন।কখনো পুরো সংবাদ দেখতেন -এমন নয়!বেশিরভাগ সময় টিভি বন্ধ করে রাখতেন।ফুল গাছের পরিচর্যা করতেন।তাদের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলা দৃশ্য দেখেছি, বহুবার।ছবির সংগ্রহের জন্য আর্ট গ্যালারির কাজ হঠাৎ, বন্ধ হয়ে গেলে স্বপ্নে দেখা স্বপ্নের কথা বললেন, দীর্ঘশ্বাসের সহিত।যে সকল দর্শনার্থীরা এখন সুলতানের ছবি, নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি আলখেল্লা পাঞ্জাবী, রঙ-তুলি, বাঁশি,তৈজসপত্র দেখতে যাই তারা জানিনা; এই গ্যালারি শিল্পীর মনের মতন করে সরকার গঠন করেননি।বিত্তবের টান তাকে টানেনি কোনোদিন। তিনি ভালোবাসতেন কবিতা,গান। নাচতেও পারতেন সুন্দর! তাঁর সর্বশেষ স্বপ্ন ছিলো, বড় একখানা নৌকা বানিয়ে সেই নৌকায় শিশুদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকবেন এবং আঁকাবেন।সমস্ত টাকা পয়সা এর পিছনে খরচ করেছেন কিন্তু, অসুস্থতার জন্য তার আর শিশুদের নিয়ে নদী ভ্রমণ করা সম্ভব হয়নি।আর্থিক সংকট মুহূর্তগুলো নিহারবালা এবং তার কন্যা সন্তান ভিষণ করে উপভোগ করেছে।কখনোবা, শিল্পীর ওপর নিভৃতে রাগও হয়েছে।এখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সুলতান মেলার নামে কেউ কেউ ব্যবসা করে। সুলতানের শৈশব,কৈশোর,যৌবনের নানাবিধ বিষয়াবলি জানলেও প্রেম সংক্রান্ত কিছু তিনি খুব একটা কাউকে বলেননি।কেন তিনি চিরকুমার ছিলেন?
এপর্যন্ত কয়েকটি নাম অবশ্য পাওয়া যায় সেগুলো ভালোবাসা, প্রেমের মৃত্যু নাকি শিল্পী মননের উৎসাহে বেড়ে ওঠা ক্ষয়ে যাওয়া বেলা বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। তবুও, আমি আমার মতো করে রেফারেন্স হতে নিয়ে বলি…
একদিন ভোরে বাবার জোর কন্ঠস্বরের কারণে ঘুম ভেঙে গেল।বাবার গলা আর কুকুরের চিৎকার একাকার।এসে দেখি তিনি কুকুরের সঙ্গে লড়ছেন। কুকুরটা কামড়ে দিয়েছে। শরীর রক্তাক্ত। বাবা যন্ত্রণাকাতর স্বরে বললেন,পাগলা কুকুর। জমিদার ডি এল রায় শুনে বললেন, মেছের কলিকাতা কাশিপুরে আমার একটা বাড়ি আছে।আমার অন্যান্য শরীকদেরও বাড়ি কাছাকাছি। গোমস্তা বাবুকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি দ্রুত চিকিৎসার জন্য চলে যাও। ইনজেকশন নিতে হবে,তা নাহলে সর্বনাশ! এখানে ভালো চিকিৎসা হয়না। বাবু তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে মোটেও দেরি করবে না। বাবা কলিকাতায় গেলেন, আমাকে ( সুলতান) সাথে নিয়ে। কলিকাতা সুলতানের ভালো লেগেছে।
একবার সুলতানকে তার বাবা দুটো খরগোশ কিনে দিলেন।এগুলো লালনপালন করে তার থেকে দুটো বাচ্চা জয়াকে দিয়েছিলাম। সে খুব খুশি হয়েছিল। আমাদের দু’জনের পশু-পাখির শখ।নদীর পাড়ে বসে ওর অনেক ছবি এঁকে দিয়েছি।সে সব জমা করে রাখতো।একদিন বিকেলে দেখলাম জয়া বটগাছের তলায় মনখারাপ করে বসে আছে।আমি কাছে গিয়ে বললাম,’ কি-রে’ মা মেরেছে! জয়া বললো- নারে’ আমরা চলে যাচ্ছি। আমি বললাম,কোথায়। জয়া বললো, কলিকাতায়।প্রথমে মনে করেছি, বেড়াতে যাবে।পরক্ষণেই,স্পষ্ট হলো,ওরা একেবারেই চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।ওখানে ইশকুলে পড়াশোনা করবে।জয়া কাঁদো গলায় অভিমান স্বরে বললো,তোর ভালোই হবে।এখানে এসে সময় নষ্ট করতে হবে না। খালি জমিদার বাবুদের বাড়িতে যাবি।শুনে আমি ওকে গালে একটা চড় মেরেছিলাম।
এস এম সুলতান যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন তার মা’ মারা যান। সংসার ধরে রাখতে বাবা আবার বিয়ে করেন। জমিদার বাড়িতে সত্যেন রায়ের স্ত্রী খুব আদর করতেন।বলতে পারেন ছেলের মতন।তার মেয়ে নাম মীরা। খুব চঞ্চল স্বভাবের। আমার মন প্রকৃতির চঞ্চলা হলেও বলতে পারেন সেটা ছবি আঁকার নেশার ঘোরে। এমনিতে আমি শান্ত মেজাজের ছিলাম।মীরাকে বরাবর বোনের নজরের বাহিরে দেখার বা ভাববার সুযোগ নেই বিন্দুমাত্র। একদিন, – সালটা ১৯৩৩। ঐ যে বলেছিলাম না-শ্যামা প্রসাদের ছবি এঁকেছিলাম। গোলগাল চেহারা,রাসভারি মুখমন্ডল। পিঠ চাপড়ে সাবাশ দিলেন জমিদার বাড়িতে বাসকারীরা। জমিদার বাড়িতে গিয়েছিলাম,প্রণাম জানাতে বয়োজ্যেষ্ঠদের।আমাকে মিষ্টি খাওয়ানো ফাঁকে মীরা বললো, আমার একটা ছবি এঁকে দিবি খুব সুন্দর করে! আমি বললাম দেবো।তোমার ছবি সুন্দর-ই হবে।এমনিতেই তুমি খুব সুন্দর! মীরা লজ্জা পেয়ে বললো,দূর তাই বলেছি কি,আমার মতন যেন হয়!
মীরাকে ভিন্ন চোখেমুখে দেখবার কিছু নেই। তবুও, মেয়েরা কখন কি’ ভেবে নেয় কে’ জানে! জয়া চলে যাবার পর বন-জঙ্গল,পশুপাখি,গাছে ওঠা,ফুল তোলা, ফুলের মধু খাওয়া সমস্ত দুরন্তপনায় ভাটা পড়েছিল বহুদিন। এমনকি খাওয়া- দাওয়াতেও অনিয়ম করতাম। সৎ মা ঘরে আসার পর,জীবনটা বৈরাগ্য হয়ে গেল যেন!
হাল পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা -২০২১ প্রকাশ পেলে জিল্লুর রহীমের লেখা অপ্রকাশিত এস এম সুলতান শিরোনামে ২৭ পৃষ্ঠাতে উল্লেখ আছে।শিল্পী নিজের ভাষ্য,’জীবন সঙ্গিনী হিসেবে খ্রিস্টান মেয়েকে বিষয় করতে পারলে ভালো হতো।আমাকে পালন করতে পারত।কিন্তু তেমন মেয়ে কই যে,সুলতান কে যথাযথভাবে বুঝবে।আমার জন্য প্রয়োজন হলে জীবন উৎসর্গ পর্যন্ত করতে পারবে।বিনিময়ে পাবে অসহনীয় দারিদ্র্যের অভিশাপ। আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জন দেয়া সেরকম মেয়ে পাওয়া কি সম্ভব’!তবে একথাও ঠিক কোনো মেয়েকে আপন করে নেবার মতো আপন বলে ভাবার মতো আগ্রহ বা ভাবাবেগ সুলতানের মধ্যে আদৌ কখনো দেখিনি।ভালোবাসা এবং সম্পর্ক বিষয়ক জিজ্ঞাসায় ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছেন, যখন মিশরে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যধর্ম ও সাংস্কৃতির ওপর কোর্স করতে গিয়েছিলাম তখন আমেরিকার থেকে এসেছিল রোজি নামের একটা মেয়ে।সুলতান তার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা পার্কে বসে অপেক্ষা করতেন।জানেন রোজি পায়ের মতন পা আমি কোনো মেয়েকে আজও দেখিনি।অপূর্ব। আমি প্রেমে পড়েছিলাম ওর পায়ের।
কানাডিয়ান মেয়ে মিসেস হার্ডসন।তার আর্থিক সহযোগিতায় সিমলার পথে পথে আঁকা ছবিগুলো নিয়ে টাউন হলে একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে একদিন বিকেলে হার্ডসন সুলতানের হাত ধরে সরাসরি বলে দিয়েছে, ‘লাল আই লাভ ইউ।এই প্রস্তাবে সুলতান বলেছেন, হোয়াই নট,বিকজ ইউ আর জাস্ট লাইক মাই মাদার। তারপরদিন তিনি সিমলা ছেড়ে চলে যান কাশ্মির।
এই হলো সুলতান।এই হলো শিল্পী সুলতানের ভালোবাসা সংক্রান্ত দিনপঞ্জি।
নড়াইলের রূপগঞ্জ গোডাউনের কুলি পাগলা,চায়ের দোকানদার মোকসেদ, কালুডাকাত,নিহারবালা ও তার কন্যা,অসংখ্য ছাত্র-শিশু স্বর্গ,লাল বাউল সম্প্রদায়, নন্দনকানন ফাইন আর্টস স্কুল যতটা শিল্পী সুলতানকে চিনবেন ততটা অন্যরা নয়।
নদী চিত্রাকে ভালোবেসে ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মহাপ্রাণ মানুষটার মহাপ্রয়াণ ঘটে।
পরিশেষে,বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে,দাবী রাখছি- মাতৃভূমি নড়াইলে তার শিল্পকর্ম যেন গ্যালারিতে সঠিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত থাকে সরকারের সেদিকে নজর বাড়ানো উচিৎ।

লেখাটি সংগ্রহ করেন খুলনা থেকে চিত্রশিল্পী মিলন বিশ্বাস।
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক
খুলনা আর্ট একাডেমি।
তারিখঃ২৬-০৬-২০২৫

সর্বশেষ - সংবাদ