পরদিন সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে কাওসার হোসেনকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সময়টা ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মধ্যরাত। এরপর পেরিয়ে গেছে ১১ বছর। কাওসারের জন্য স্ত্রী মিনু আক্তার ও মেয়ে লামিয়ার অপেক্ষার পালা আজও শেষ হয়নি।
গতকাল শুক্রবারও স্বামীর সন্ধানে একটি ছবি হাতে নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এসেছিলেন মিনু। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা হয় কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদকের। মিনু বলেন, ‘একটা মানুষ কোথায় হারিয়ে গেল—কেউ জানে না। আমি এই গুমের বিচার চাই।
আর কোনো লামিয়াকে যেন বাবার অপেক্ষায় থাকতে না হয়।’
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে এসেছিলেন মিনু। জানালেন, কাওসার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে র্যাব, থানা, ডিবি অফিসসহ সম্ভাব্য সব জায়গায় গেছেন। কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি।
তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা কাওসারকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মিনু। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পশ্চিম নাখালপাড়ার ভাড়া বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় আমার স্বামীকে। যাওয়ার সময় বাসার অনেকে আটকের কারণ জিজ্ঞেস করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা জানান, এমনিতেই নেওয়া হচ্ছে। কাল সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তাকে আর ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
সেদিন আমি বাসায় ছিলাম না। আমার স্বামীকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমার মেয়ে লামিয়া আক্তার মিমের বয়স মাত্র তিন বছর।’
স্বামীর খোঁজ চেয়ে মিনু আক্তার বলেন, “স্বামী যখন গুম হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। নিখোঁজের পর থেকে হন্যে হয়ে তাকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার মেয়ে বলে, ‘আম্মু, আমি কি আব্বুকে দেখলে চিনতে পারব?’ সে রাস্তায় কোনো পাগল দেখলে মনে করে এটাই বুঝি তার বাবা। আমার কাছে এসে কান্না করে। কোথায় আছে সে? আদৌ ফিরবে কি না, আমরা কিছুই জানি না। তবে আমরা বিশ্বাস করি, একদিন ঠিকই ফিরে আসবে সে। আমার স্বামীর মতো যারা গুমের শিকার হয়েছে, নতুন সরকারের কাছে তাদের সন্ধান দাবি করি। তারা যেন সবাইকে খুঁজে বের করে দেয়।’
মিনু আক্তারের মতো শহীদ মিনার চত্বরে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুমের শিকার মানুষদের স্বজনরা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি নিয়ে তারা দীর্ঘ মানববন্ধন করে। তারা পরিবারের কাছে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার এবং এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সুবিচারের দাবি জানায়।
কর্মসূচিতে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়ক এবং গুমের শিকার বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি এসব ব্যক্তির তথ্য অবিলম্বে তাঁদের পরিবারকে জানানোর দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। অবশিষ্ট অপশক্তিগুলো এখনো দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যগুলো এখনো পরিবারের কাছে আসছে না। আমরা জানতে চাই, আমাদের প্রিয়জন কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন কি না? মেরে ফেলা হলে কোথায় তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছে?’