নিজস্ব প্রতিবেদক : স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ (ইউনিট) এর দায়িত্বে থাকা জাবেদ করিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম,ঘুষ, দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সরকারি চাকরির যেন টাকার মেশিন হাতে পাওয়ার মত ঘটনা।অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন দপ্তরের রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতির আদ্যোপান্ত। পতিত সরকারের আমলে বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাদের মধ্য অন্যতম দুর্নীতিবাজ জাবেদ করিম। সাম্প্রতি তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সড় ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ (ইউনিট) এর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিজের এবং স্ত্রীর নামেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত কোটি টাকার অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের দাপুটে প্রভাব দেখিয়ে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন। রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, আফতাবনগর, বসুন্ধরা, ঝিলমিল আবাসিক, কেরানীগঞ্জ ,ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নিজের ও তাঁর স্ত্রীর নামে একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি। এসব সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ইতোপূর্বে ওই অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল রসিদ এর দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আবার অপকর্মের দায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী রনজিত কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।এ দপ্তরের দুর্নীতি যেন পিছু ছাড়ছে না।একের পর এক ঘটনা চাউর হলে গোটা অধিদপ্তরে অস্বস্তি বেড়েছে।
বিগত সরকারের আমলে জাবেদ করিমের কোথায় কী সম্পদ এবং কিভাবে টাকার পাহাড় গড়েছেন তার বিবরণ তুলে ধরা হলোঃ এলজিইডির মুন্সীগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে প্রতিটি কাজের জন্য তিনি ২ শতাংশ করে ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন সেখানে শতকোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। সেই সময় তার ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৪৯ টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। এ গড়মিল কাণ্ডে বোঝা যায় তিনি সরকারের টাকা লোপাট করতেন। এরপর বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র প্রকল্পের (এমডিএসপি) পরিচালক থাকাকালে প্রায় শতকোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর গুলশান ১-এর ১৩০ নম্বর সড়কের ১১/বি-এর আশক্স আমারি ওয়ে ডেভেলপার্স এলটিডির পাশে ৩০ কাঠা জমির ওপর বিশাল গ্যারেজ রয়েছে জাবেদ করিমের। গ্যারেজটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। এ ছাড়া উত্তরা, বনানী, মিরপুরে রয়েছে তার আলিশান বাড়ি ও ফ্ল্যাট। তার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। বনানীর ২৫/এ সড়কের ৫৫ নম্বর বাড়িটি তার। এই বাড়ি নির্মাণে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রগতি সরণির শহিদ আব্দুল আজিজ রোডের ৩০ কাঠার ৪৮নং প্লটটিও তার। প্লটটি তিনি কিনেছেন প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় করে। সেখানে পেইন টেকিং অটোমোবাইলস নামে গ্যারেজ ভাড়া দিয়েছেন। পূর্বাচলের ৩ নম্বর সড়কের ৬৫ নম্বর প্লটটি ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে ক্রয় করেছেন।
গাজীপুর চৌরাস্তা সংলগ্ন ৮ নম্বর রোডের ৭৫ নম্বর বাড়িটিও তাঁর। এই বাড়িটি তিনি ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় কিনেছেন। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কের ৩৬ নম্বর বাড়িতে ৩২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়া আফতাবনগরের ২ নম্বর সড়কের ৯৮ নম্বর প্লটটিও স্ত্রীর নামে কিনেছেন ১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে। বসুন্ধরা আবাসিকের ডি ব্লকে ৭ নম্বর সড়কের ৬৯ নম্বর প্লটটি ৪০ কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন। সেখানে ৮ তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাবেদ করিমের দুর্নীতির প্রধান সহযোগী ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রীর এপিএস মো. জাহিদ হোসেন চৌধুরী। তারা মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এলজিইডিতে প্রকল্প পরিচালক কিংবা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগে পদভেদে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করা হতো।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জাবেদ সিন্ডিকেট ঢাকার আগারগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে চলতেন। সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ বণ্টন, পদায়ন, বদলি, সবকিছুতেই চলত টাকার খেলা।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অভাবনীয়ভাবে অর্থ ও ক্ষমতা লাভ করলেও, বর্তমানে নিজেকে বিএনপি পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার চেষ্টা করছেন জাবেদ করিম।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালের শেষ দিকে সরকার পতনের আগমুহূর্তে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে ‘জাবেদ সিন্ডিকেট’ হাসিনার ব্যক্তিগত তহবিলে কোটি কোটি টাকা অনুদান দিতেন। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে নিজেদের অবৈধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন তারা।
মুন্সীগঞ্জে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালীন প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে ২% হারে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে জাবেদের বিরুদ্ধে। তৎকালীন সময়ে তার নামে ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৪৯ টাকার অডিট আপত্তিও ওঠে।
পরবর্তীতে, বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র প্রকল্পের (MDRSP) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠে।
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা মো. আরমান হোসেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর জাবেদ করিমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। সেই অভিযোগপত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অনুসন্ধানে উঠে আসে তার বিপুল অবৈধ সম্পদের বিবরণ।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন , জাবেদ করিমের আমলে বদলি ,পদায়ন ,এবং প্রকল্প অনুমোদন সবকিছুই ছিল দালালি ও কমিশনের খেলায় পরিণত।
এ বিষয়ে জাবেদ করিমের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তা গ্রহণ করেননি । হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালেও কোন সাড়া মেলেন।