সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঠিক তথ্য পেতে ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা কামনা * ভারতকে শেখ হাসিনা সরকারের গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে হবে -মাহফুজ আলম * দেশের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ -মাওলানা সাজেদুর রহমান * কোনো বিভেদ নেই, সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই : অবিনাশ মিত্র * সম্প্রীতি যেন বজায় রাখতে পারি -ফাদার অ্যালবার্ট রোজারিও
নানা কারণে মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে আমরা একে অপরের শত্রু নই। আমরা সবাই বাংলাদেশি এবং একই পরিবারের সদস্য। কিন্তু দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং বাস্তবতার মধ্যে ফারাক রয়েছে। আর দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো হামলা হলে সঠিক তথ্য দিয়ে ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা দিতে হবে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন।
সংলাপে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের নেতারা যোগ দেন। এসব নেতা সরকারের সঙ্গে একমত পোষণ করে দেশের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ধর্মীয় নেতারাও নিজ অবস্থান থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময়ে মাহফুজ আলম বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতকে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার সরকারের গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে হবে।
আওয়ালী লীগ সরকারের পতন হলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যান। এরপর থেকেই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই বৈরী সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরকে অভিযুক্ত করছে।
এ অবস্থায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় সোমবার বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলা করে একটি উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন। এ সময়ে সংগঠনটি ব্যাপক ভাঙচুরের পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলে। এরপর বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার রাতে ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বুধবার রাজনৈতিক দল এবং বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়।
ড. ইউনূস বলেন, দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কোনো ঘটনা ঘটলে অবিলম্বে এ ধরনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এ ধরনের ঘটনা রোধে একটি পরিবেশ সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক প্রতিকার নিশ্চিত করা জরুরি।
ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পত্র-পত্রিকা দেখে মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনাদের সঙ্গে বসা। সরকার গঠনের আগে বিমানবন্দরে দেওয়া বক্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তখন বলেছিলাম আমরা একটা পরিবার। আমাদের নানা মত, নানা ধর্ম থাকবে। নানা রীতিনীতি থাকবে কিন্তু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। তিনি বলেন, শত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা পরস্পরের শত্রু নই। আমাদের জাতীয়তা, পরিচয়ের প্রশ্নে এক জায়গায় চলে আসি। আমরা বাংলাদেশি এবং এক পরিবারের সদস্য।
তিনি আরও বলেন, শপথ গ্রহণের পর শুনলাম সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর পরপরই আমি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেলাম। সেখানেও বললাম আমরা এক পরিবারের সদস্য। সব দাবি-দাওয়া বাদ দিলেও একটা দাবি পরিষ্কার। সবার অধিকার সমান। বলার অধিকার, ধর্মের অধিকার এবং কাজের অধিকার। সেটা এসেছে সংবিধান থেকে। নাগরিক হিসাবে প্রাপ্য, রাষ্ট্রের সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব। শুনলাম এখনো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। তাই সবাইকে নিয়ে বসলাম এটা থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়। দুর্গাপূজার নিরাপত্তায় সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সেটা পুরো জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, এখন আবার নতুন কথা, হামলা-অত্যাচার শুরু হচ্ছে। বিদেশি গণমাধ্যম বলব না, প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। তবে আরেক খবরে বলা হলো নির্যাতন হচ্ছে না। তথ্যের মধ্যে ফারাক আছে। এটা ঠিক নয়। এটার অবসান হতে হবে। তথ্যের গরমিল কেন? প্রশ্ন হলো, ওরা যা বলছে তা কি মিথ্যা? নাকি আমরা মিথ্যা বলছি। সত্যটা কোথায়। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্যের ফারাক নেই। সেখানে সঠিক তথ্য কীভাবে পাব।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা এক পরিবারের মানুষ হিসাবে সামগ্রিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি। সেখানে তথ্য ও প্রতিকার হলো বড় বিষয়। কোনো সমস্যা হলে সমাধান করতে হবে। সংখ্যালঘু সমস্যার বিষয়ে অবাধ, সত্য তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, সে বিষয়ে ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ চান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, কীভাবে নিরাপদে সংগ্রহ করব, যে তথ্য দিচ্ছেন, সে যেন বিব্রত না করে তাও নিশ্চিত হতে হবে।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে মাহফুজ আলম বলেন, আমরা বলি না দেশে নিপীড়ন (সংখ্যালঘু) একেবারেই হয় না। অলআউট সেটি বলাটা অসত্য। কিন্তু কোথাও যদি নিপীড়ন হয়ে থাকে, এর বিপরীতে সরকারের ব্যবস্থাকেও আপনারা প্রচার করবেন। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে নির্যাতন হওয়ার পরে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এসব ব্যবস্থাকে গণমাধ্যমে প্রকাশ করলে সংখ্যালঘু ভাই-বোনেরা আস্থা পাবেন। কারণ এই দেশটি তারাসহ সব নাগরিকের।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমাদের সম্প্রীতি দরকার। কিন্তু এর সঙ্গে যেন ভয়ের বিষয়টি জড়িয়ে না যায়। নাগরিকরা সবার সঙ্গে মেলবন্ধন রেখে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে, সরকার যে চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, আমরা এখন ঠেকায় পড়েছি, এজন্য হিন্দুদেরকে ডেকেছি, এ রকম নয়। এটি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা যেন সহজাত ঐক্য বজায় রাখতে পারি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ যে নতুন পথে রওয়ানা দিয়েছে, এই পথে যাতে দেশের সব পথ, মত ও ধর্মের লোকদের নিয়ে আমরা অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারি, সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
মাহফুজ আলম আরও বলেন, একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য নিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে দাঁড় করাতে চাই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে বাস্তবায়ন করতে পারি, সে জন্য ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন চেয়েছি। ধর্মীয় নেতারা অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন দিয়েছেন। আশা করি বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছে, যেভাবে সচেতনতা বাড়ছে, সেটি ভবিষ্যতে দেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে, ভারতকে আগে এর স্বীকৃতি দিতে হবে। এটি প্রথম বিষয়। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশে যত ধরনের নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, আমরা নিজেদের জায়গা থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। ভবিষ্যতেও আমরা সবটুকু করব। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যই, তাদের মিডিয়ার ভূমিকা বড় প্রশ্ন। তাদের মিডিয়ার এই ভূমিকাকে কার্টেল করতে হবে। এটা তাদের সঙ্গে যখন কথা হয়েছে, আমরা বারবার সেটা বলেছি। আপনার যেভাবে মিস ইনফরমেশন (অপতথ্য) দিয়ে সমন্বিত ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন, তা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য হুমকিস্বরূপ। আশা করি তাদের সুমতি হবে।
মাহফুজ আলম বলেন, বাংলাদেশের মিডিয়ার এখন দায়িত্ব এসে পড়েছে, সত্যটাকে তুলে ধরার। এটা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের গণ-অভ্যুত্থান আমাদেরকে রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহ এক ধরে বাংলাদেশে যে অবস্থা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। আজকে বৃহত্তর ৪টি ধর্ম মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আমরা আহ্বান করেছি। তাদের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছি। তাদের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের কাছে মেসেস দেওয়ার চেষ্টা করেছি, বাংলাদেশের মানুষ সম্প্রদায়গত দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই এক।
তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রোঅ্যাক্টিভ ভূমিকা পালন করবে। কোনো ধরনের হঠকারিতার আশ্রয় প্রশয় দেবে না। যত বেশি সচেতনতা বাড়ানো যায়, সেদিকে আমরা আগাব। দেশের ভেতরের শক্তি এবং সংহতি শক্তি বৃদ্ধির দিকে আমরা নজর দেব। দেশের বাইরে যতই ষড়যন্ত্র হোক, আমরা দেশের ভেতরে যত বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারব, দেশ তত এগিয়ে যাব।
এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য। কিন্তু মাত্র ৭-৮টি দেশের বাংলাদেশে দূতাবাস রয়েছে। বাকি দূতাবাস ভারতের দিল্লিতে। তাই আগামী ৯ তারিখে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের কথা হবে। সেখানে এ বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে।
আড়াই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বিভিন্ন ধর্মের মোট ৩২ জন প্রতিনিধি অংশ নেন এবং ২৬ জন বক্তব্য দেন। সব ধর্মের নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ ভালো আছেন। শুধু ভারতীয় মিডিয়া অপপ্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করছে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদুল্লাহ, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব আবদুল মালেক, মুফাসসির আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান, নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক, মুহিউদ্দিন রাব্বানী, আহমদ আলী কাসেমি, আব্দুল কুদ্দুস,বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব, সহকারী মহাসচিব সাখাওয়াত হোসাইন রাজি ও অর্থ সম্পাদক মনির হোসাইন কাসেমি, রমনা হরিচাঁদ মন্দিরের পুরোহিত অবিনাশ মিত্র, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়, রমনার স্যান মেরিস ক্যাথিড্রালের প্রধান পুরোহিত অ্যালবার্ট রোজারিও, লক্ষ্মীবাজারের সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র উপদেষ্টা সিস্টার রেভা ভেরোনিকা ডি কস্তা, গারো সম্প্রদায়ের জনসন ম্রি কামালসহ আরও কয়েকজন আলেম সংলাপে অংশ নেন।
দেশের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ : সংলাপে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেন। সংলাপ শেষে সাজিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। সবাই ভাই ভাই। কুরআন বলেছে সমগ্র মানবজাতি আদম সন্তান। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা সবার দায়িত্ব। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে। বরং পাশের দেশে সম্প্রীতি নেই। দুজন ভাইকে হত্যার পরও বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। দেশের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ। যারাই ষড়যন্ত্র করবে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করব।
নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, সব ধর্মের নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ ভালো আছেন। শুধু ভারতীয় মিডিয়া অপপ্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করছে। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তা রুখে দেব ইনশাআল্লাহ।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, দেশের পরিস্থিতি সবাই জানেন। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। পরাজিত শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করে দেশে ঢুকতে চায়। অন্তর্বতীকালীন সরকারকে অকার্যকর করতে চায়। আমরা দল-মত নির্বিশেষ সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকব সেটা বলেছি। অন্য ধর্মের নেতারাও বলেছেন, তারা এখানে কোনো রকমের বৈষম্যের শিকার হননি। তাদের ওপর কোনো প্রকার আক্রমণ হচ্ছে না। তারা কোনো প্রকার ভয়ভীতির মধ্যেও নেই।
অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জবাব দিতে হবে : আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের শায়খ আহমদুল্লাহ বলেন, আমাদের মধ্যে চমৎকার ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় আছে। আমরা মন খুলে কথা বলেছি এবং প্রধান উপদেষ্টা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন একটি সুন্দর সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে তারা কাজ করছেন। যেখানে কোনো ভয় থাকবে না। আমরা ধর্মীয় জায়গা থেকে দায়িত্বশীল এবং মুসলমানরা ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন।
ফরিদপুরে ৪ জন হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। সেখানেও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আমরা সম্প্রীতির বাংলাদেশকে বিশ্বে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে নিয়ে যেতে চাই। সবাই মিলে বলছি, শান্তি-সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ব। ইসলাম আমাদেরকে অন্য ধর্মের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে শিক্ষা দিয়েছে। সংখ্যালঘু ভাইদের নিরাপত্তার জন্য সবাই কাজ করছি। সরকারও তার জায়গা থেকে কাজ করছে। আমাদের মাঝে কোনো ফাটল নেই।
তিনি আরও বলেন, যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষে কথা বলতে হবে। তাদেরকে জবাব দিতে হবে। আমাদের ওপর মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কোনো বিভেদ নেই, সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই : রমনা শ্রীশ্রী হরিচাঁদ মন্দিরের ধর্মীয় সহ-সম্পাদক অবিনাশ মিত্র বলেন, আমরা আজকে প্রধান উপদেষ্টার ডাকে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুরা একত্রিত হয়েছি। সেই উপস্থিতিতে বিভিন্ন রকমের কথা হয়েছে। আমাদের কথাগুলো সব উপদেষ্টা ধৈর্যের সঙ্গে শুনেছেন এবং আমাদের যে দুঃখ-কষ্ট সব কথাই শুনেছেন। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সবার কথা ধৈর্যের সঙ্গে শুনেছেন এবং সেভাবেই এগোবেন সেটাই আমাদের বিশ্বাস।
তিনি আরও বলেন, আমরা যারা বাংলাদেশে আছি, আজকে বিভিন্ন ধর্মগুরুরা উপস্থিত হয়েছি, আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু বিভেদটা কোথায়? কে করছে? যারা বিভেদ তৈরি করছে তারা ওখানে বসে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন। সংলাপে আমি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান-সবাই তো উপস্থিত হয়েছি। কারও মধ্যে ফাটল নেই, বিভেদ নেই, সবাই কিন্তু এক জায়গায়। কিন্তু আমাদের মধ্যে ঢুকে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, খারাপ কিছু তৈরি করে, তাদের স্বার্থ হাসিল করে, এটা আমরা চাই না। এটা বাংলাদেশ। আমরা সব জাতি সমানভাবে বাঁচতে চাই, বেঁচে আছি। কোনো তো সমস্যা নেই। এখানে আমরা সবাই সমানভাবে মিলেমিশে আছি। কোনো তো সমস্যা নেই। যারা আমাদের অ্যাডভোকেট ভাইকে মেরেছে, কে মেরেছে? সে কি হিন্দু মুসলিম নাকি দুষ্ট তা নিশ্চিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান অবিনাশ মিত্র।
তিনি বলেন, কিন্তু এটাকে পুঁজি করে বাইরের রাষ্ট্র আমাদের ওপর মাছের আধারির মতো একটা বড় কিছু তৈরি করে নিল, সেটা আমরা চাই না। আমরা হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই। সবার সমান অধিকার। যদি কখনো কারও মাধ্যমে নির্যাতিত না হই। যদি কেউ করে সেটাও আপনারা (সাংবাদিক) তুলে ধরেন। তাহলে তারা সেটা হাসিল করতে সুযোগও পাবে না।
বাংলাদেশের মানুষ সম্প্রীতির মানুষ : রমনার সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রালের ফাদার অ্যালবার্ট রোজারিও বলেন, অনেক সৌহার্দ পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যে কথা বলে গেছে তার সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করেছি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে আছে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ইসকনের বিষয়ে তাদের মনে একটা ক্ষত, একটা ক্ষোভ, কষ্ট আছে। প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি এই ক্ষোভটাকে নিরাময় করতে হবে। আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশে এই ধরনের একটা সংলাপের ব্যবস্থা করা হোক যেন সারা বিশ্বের মিডিয়া যেন জানতে পারে যে বাংলাদেশের মানুষ সম্প্রীতির মানুষ। তারা মিলেমিশে থাকে। তারা একসঙ্গে পথ চলে।
এ ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আমাদের একজন অ্যাডভোকেট মারা গেছেন। ভারতে অনেক ছোটখাটো মিডিয়াতে উসকানিমূলক কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে আসলেই সম্প্রীতির মানুষ, আমরা অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। সেই সম্প্রীতি আমরা যেন বজায় রাখতে পারি।
তিনি আরও বলেন, আমরা আরেকটা বিষয় বলেছি ইসকনের যে ভাইকে আটক করা হয়েছে তাকে আইনগতভাবে জামিনের বিষয়টা যেন বিবেচনা করা হয়। সংলাপেও এক ভাই জোরালোভাবে বলেছেন, যদি আইনের পথ খোলা থাকে তার জামিনের বিষয়টি যেন চিন্তা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা আরেকটা বিষয় জোর দিয়ে বলেছি যে, ইসকনের যে ভাই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন, আইনে যদি পথ খোলা থাকে তার জামিনের বিষয়টা বিবেচনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের প্রস্তাব : বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র চাই। যে পরিবেশটা ৫ আগস্টের পর তৈরি হয়েছে। আমরা শান্তি-সম্প্রীতিতে বসবাস করতে চাই। যেখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী থাকবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন করা যায় কি না সেই প্রস্তাব দিয়েছি। এই কর্মসূচি যাতে বিভাগীয় শহরেও করা যায় সেটি বলেছি। আমাদের চার ধর্মের মধ্যে যে ঐক্য সেটি যেন অটুট থাকে। সব অধিকার যাতে বিঘ্ন না হয় এসব বিষয়েও কথা বলেছি।