মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, ৫ মে গভীর রাতে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকারীদের সমূলে নির্মূল করার লক্ষ্যে তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে আসামিদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের অসাধু সদস্যরা নিরস্ত্র কর্মীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালান। এতে আড়াই থেকে তিন হাজার কর্মী নিহত হন।
আসামিরা রাতের মধ্যেই লাশ ট্রাকে করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দিয়ে আসেন। লাশগুলো গুম করে ফেলা হয়। এর ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ নির্বিচার গুলি চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়া হেফাজতের কমপক্ষে ১০ হাজার কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। কয়েক হাজার কর্মী শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
কয়েক শ শিশু নির্মম গণহত্যার শিকার হয়। এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২), ৪(১) ৪(২) ধারা অনুযায়ী গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) ও তদন্ত কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, অভিযোগটি গ্রহণ করে কমপ্লেইন্ট রেজিস্টারভুক্ত করা হয়েছে। এখন এটি মামলা। অচিরেই তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে মামলার তদন্ত শুরু হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করতে আবেদন করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
রাজধানীতে মামলা
পুলিশ জানায়, মুদি দোকানি আবু সায়েদকে হত্যার অভিযোগে গত ১৩ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় আমির হামজা শাতিল নামের এক ব্যক্তি মামলা করেন। এই মামলার আসামির তালিকায় শেখ হাসিনাসহ ছয়জনের নাম রয়েছে। বাকি পাঁচজন হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
এ ছাড়া পুলিশের অজ্ঞাতনামা কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়েছে মামলায়। মামলার এজাহারে বলা হয়, আন্দোলনের মধ্যে গত ১৯ জুলাই বিকেলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালালে মুদি দোকানি সায়েদ নিহত হন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায়ও মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। বাসস জানায়, শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে টোল প্লাজায় ফল দোকানি ফরিদ শেখকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহম্মেদের আদালতে এই মামলার আবেদন করা হয়।
রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় কবি নজরুল কলেজের ছাত্র ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজী, সাধারণ সম্পাদক এস এম আকতার হোসাইনসহ জবি ছাত্রলীগের সাত নেতাকে আসামি করা হয়েছে।
গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে মামলাটি করেন নিহত কলেজছাত্রের মা কুলছুমা আক্তার। এ সময় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সূত্রাপুর থানার পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। এই মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান করে ৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পাঁচ জেলায় মামলা
রংপুরে রাজা রামমোহন ক্লাবের সামনে ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ ৫৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল সবজি বিক্রেতার স্ত্রী জিতু বেগম হত্যা মামলাটি করেন। বিকেলে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক রাজু আহমেদ বাবু মামলাটি গ্রহণ করে কোতোয়ালি থানায় এটি রেকর্ড করার নির্দেশ দেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোফাজ্জল হোসেন বকুল জানান, মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে সাবেক সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, হাসানুল হক ইনু, নাঈমুল ইসলাম খান ও রাশেদ খান মেনন রয়েছেন। আইজিপিসহ আট পুলিশ কর্মকর্তা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ জেলা, মহানগর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও আসামি। ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে রংপুরে হত্যার ঘটনায় মোট পাঁচটি হত্যা মামলা হলো।
শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৮২ জনের নামে বগুড়ায় আরেকটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। গতকাল সকালে বগুড়া শহরের চক আকাশতারা মহল্লার বাসিন্দা নিহত রিকশাচালক কমর উদ্দিন ওরফে বাঙ্গির স্ত্রী তহমিনা বেগম বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় মামলাটি করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরো ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গত ৪ আগস্ট দুপুরে বগুড়া শহরের নবাববাড়ি সড়কে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিহত হন বাঙ্গি।
বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলায় শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৬ আগস্ট শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ১০১ জনের নামে স্কুল শিক্ষক সেলিম হোসেনকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে বগুড়া সদর থানায় একটি হত্যা মামলা হয়।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২০ জুলাই কাঁচপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরিবহন শ্রমিক জনি নিহত হওয়ার ঘটনায় এই মামলা হয়। গতকাল দুপুরে সোনারগাঁ থানায় নিহত জনির বাবা ইয়াসিন মিয়া মামলাটি করেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত, সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুম, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু, আলী হায়দারসহ ১৮৭ জন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরো ১০০ থেকে ১২০ জনকে আসামি করা হয়।
জয়পুরহাটে অটোচালক মেহেদী (২৫) নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ২১৭ জনের নামে মামলা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট জয়পুরহাট থানা ঘেরাওয়ের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মেহেদী নিহত হন।
গতকাল দুপুরে নিহত মেহেদীর স্ত্রী জেসমিন আক্তার বাদী হয়ে জয়পুরহাট আদালতে মামলাটি করেন। জয়পুরহাট চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতিকুর রহমান মামলাটি আমলে নিয়ে এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করতে সদর থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ও সাবেক এমপি সামছুল আলম দুদুর নাম রয়েছে। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা ৩০০ থেকে ৩৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার কৃষক সাইফুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ৩৬৭ জনের নামে মামলার আবেদন করা হয়েছে। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ময়মনসিংহ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ৬ নম্বর আমলি আদালতের আবেদনটি পেশ করা হয়। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইকবাল হোসেনের আদালতে মামলার আবেদনটির শুনানি হয়। শুনানি শেষে এই ঘটনায় এর মধ্যে কোনো মামলা হয়েছে কি না পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ফুলপুরের ওসিকে আদেশ দিয়েছেন আদালত। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ময়মনসিংহ আদালত পরিদর্শক মো. সফিকুর রহমান। ময়মনসিংহ জেলা উত্তর কৃষক দলের সদস্যসচিব শাহ মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে মামলার আবেদনটি করেন।
মামলার আবেদনে শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুর কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানসহ ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ ও রংপুর, বগুড়া অফিস, আঞ্চলিক প্রতিনিধি, সোনারগাঁ, জয়পুরহাট প্রতিনিধি ও জবি সংবাদদাতা]