মোহাম্মদ সিরাজুল মনির (চট্টগ্রাম ব্যুরো সংবাদদাতা): চট্টগ্রাম জেলার মহানগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন হামজারবাগে অবস্থিত রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা প্রধান শিক্ষকগণ আলোচিত সমালোচিত হলেও সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৩০ মে বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ছিল বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে টাকা আত্মসাৎ করার ভয়ংকর কারিগর।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায় মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত। ছাত্র জীবনে পড়ালেখা করা খালি সময়ে ছোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার এক শ্রেণী শিক্ষকের ট্রাংকের তালা ভেঙ্গে টাকা চুরি করার সময় ধরা পড়েছিল। ইসলামী ছাত্রসেনা রাজনীতি করার সময় অর্থ আত্মসাত ও দুর্নীতি করার দায়ে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার হয়।
আনোয়ারা উপজেলার বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার সময় দুর্নীতি অর্থ আত্মসাত ও নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত হওয়ার অপরাধে কয়েকবার সাময়িক বরখাস্ত হন। সেখানে বরখাস্ত হওয়ার পরে অত্যন্ত সুকৌশলে ২০০১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় যোগদান করার পর থেকেই তার অপকর্ম শুরু হয়। দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাত করার দায়ে ২০০৩ সালের ৩১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার সাময়িকভাবে বহিষ্কার হন আবু তৈয়ব। তখন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অসৎ কিছু সদস্যদের সহায়তায় ২০০৩ সালের দুই অক্টোবর আবার প্রধান শিক্ষক পদে পুনর্বাহল হন রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। পুনরবহাল হওয়ার পর থেকে পুনরায় তিনি অপকর্ম শুরু করেন।
২০০৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষার অনুর্তীর্ণ ৪৪ জন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা অবৈধভাবে নিয়ে ফরম পূরণ করেন এবং তা তদন্তে প্রমাণিত হয় ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট। সে সময় দ্বিতীয় বার বরখাস্ত হন তিনি। সেসময় জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট বাবু সত্যজিৎ কর্মকার তার দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে আসলে সকল দুর্নীতির প্রমাণসহ ৫ লক্ষ ৯ হাজার ৮৭৪ টাকার অনিয়ম পায়।
সে সময় সকল দুর্নীতির দায়ে ২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি চূড়ান্ত বরখাস্ত হন। ২০০৫ সালের ৭ মে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের আপিল অ্যান্ড আরবিটেশন কমিটি যা শিক্ষকদের বিচার আদালত হিসেবে গণ্য হয় তাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করেন। এতে তিনি শিক্ষকতা পেশায় চাকুরী করার যোগ্যতা হারান। স্থায়ীভাবে বরখাস্ত হওয়ার পরবর্তী সময়ে আবু তৈয়ব এর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা চলাকালীন সময়ে এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন কমিটির কিছু দুর্নীতিবাজ এবং অসৎ সদস্য ২০০৯ সালের ১৯ অক্টোবর তাকে আবারো প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে পুনর্বহাল করেন।
পুনরায় প্রধান শিক্ষক পদে আবু তৈয়ব যোগদান করার পর থেকে তার অপরাধের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। তার সকল প্রকারের দুর্নীতি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ এবং নারী কেলেঙ্কারী সহ সহ সকল অভিযোগ নিয়ে একজন অভিভাবক চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড বরাবরে আবেদন করেন ২০২৩ সালের ৮ই মে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড তদন্ত কমিটি গঠন করে ২০২৩ সালের ২৯ মে বিদ্যালয়ের সারা জমিনে পরিদর্শন করে তদন্ত করেন। তদন্ত কমিটি সকল অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আবু তৈয়বকে সাময়িক বরখাস্ত করার পরামর্শ দেন বিদ্যালয়ের এডহক কমিটিকে।
কমিটি জরুরী সভা আহবান করে ২০২৩ সালের ২৯ মে তাকে সাময়িক দরখাস্ত করেন এবং তদন্ত কমিটি গঠন করেন। পরবর্তীতে বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু তৈয়ব সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ করেন এবং একই সাথে মহামান্য হাইকোর্টে একটি হৃদ মামলা দায়ের করেন যার নম্বর ৭০১০/ ২০২৩। মহামান্য হাইকোর্ট তা ডিসপোজ করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কে আইননানুগ ভাবে নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেন। সে সময় ভোট কর্তৃপক্ষ শুনানি করে কমিটির উপস্থিতিতে মোহাম্মদ আবু তৈয়ব সকল প্রকারের অপরাধ স্বীকার করেন এবং চাকরি হতে তাকে অবসরের আবেদন করেন। বোর্ডের শুনানি থেকে তিনি যাওয়ার পর মহামান্য হাইকোর্টে আবু তৈয়ব নিজে বাদী হয়ে আবারো একটি মামলা দায়ের করেন।
এতে বিদ্যালয়ের কমিটির কার্যক্রম ছয় মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে মহামান্য হাইকোর্ট। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আদেশের বিরুদ্ধে একটি আপিল মামলা দায়ের করলে আবু তৈয়বের রিটে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয় হাইকোর্ট যা এখনো চলমান রয়েছে। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দেখা যায় ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২৯ শে মে পর্যন্ত আবু তৈয়ব এর চাকরি কাল ছিল বেআইনি এবং অবৈধ। ফলে তার গৃহীত সরকারি ও বিদ্যালয় ফান্ডের টাকা মোট এক কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার একশত ৫৬ টাকা সরকারি কোষাগার ও বিদ্যালয়ের হিসাবে ফেরত যোগ্য।
তাছাড়া শিক্ষা বোর্ডের দ্বিতীয় চিঠিতে উল্লেখ আছে বাড়তি ৬২ লক্ষ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। বিদ্যালয়ের টেবিল মেরামত বাবদ ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস অফিস খরচের নামে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ কয়েক লক্ষ টাকা অনৈতিক লেনদেন, সহ আরো বিভিন্ন খাত লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন যা দিয়ে তিনি বোয়ালখালীর পৈতৃক নিবাসে বিশাল বিলাসবহুল বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীতে জায়গা ফ্ল্যাট ও দোকান ক্রয় করেছেন এবং ব্যাংকে রেখেছেন ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে। তার বরখাস্তের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে মামলা করেন যা চলমান ও বিচারাধীন।
এই মামলা বিচারাধীন এর সময়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে তিনি প্রভাবিত করে পূর্বের ন্যায় বিদ্যালয়ে পুনর বহাল হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত তিনি সকল রিট মামলায় পরাজিত হওয়ার পর পুনর্বহালের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। স্থানীয় সচেতন অভিভাবকদের দাবি এ ধরনের প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের পুনর্বহাল হলে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয়ে যাবে। `