জুমার দিন। আকাশে যেন নূরের পরত। বাতাসে রহমতের ঘ্রাণ। এই দিনটি সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
সৃষ্টির প্রথম পুরুষ আদম (আ.) এই দিনেই সৃষ্টি হয়েছিলেন। এই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং এই দিনেই তিনি পৃথিবীতে প্রেরিত হন। এই দিনেই কিয়ামতের বাঁশি বাজবে। তাই ইসলামী শরিয়তে এই দিনকে বলা হয়েছে সাপ্তাহিক ঈদের দিন।
এই মহিমান্বিত দিনে আল্লাহর এক অশেষ নেয়ামত হলো সুরা কাহাফ। এ সুরার উচ্চারণে যেমন প্রশান্তি, তেমনি রয়েছে হৃদয় আলো করে তোলার এক রহস্যময় ক্ষমতা। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে হাদিসে—
مَنْ قَرَأَ سُورَةَ الْكَهْفِ فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ، أَضَاءَ لَهُ مِنَ النُّورِ مَا بَيْنَ الْجُمُعَتَيْنِ
‘যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহাফ পাঠ করে, তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত নূর আলো বিকিরণ করে।(-বায়হকী, হাদিস: ৫৯৯৬)
একটু ভাবুন তো; একটি সপ্তাহ শুরু হলো।
সামনে নানা ফিতনা, পাপের ফাঁদ, মনোবিকার আর অন্তরের বিভ্রান্তি। এসবের মধ্যেও যদি আপনার অন্তরে একটি আধ্যাত্মিক আলো থাকে, একরাশ নূর, যা আপনাকে পথ দেখাবে। তা কত বড় নিয়ামত! সুরা কাহাফ হতে পারে আপনার জন্য সেই আলোর প্রদীপ, যা এক সপ্তাহের আঁধারে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে রাখে আপনার মনের গহীনে।
এই সুরাটিতে চারটি অলৌকিক ঘটনার বিবরণ রয়েছে। (১) যুবক গুহাবাসীদের ঈমান রক্ষা, (২) এক ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে পার্থিব বিত্তের ভ্রান্তি, (৩) মূসা (আ.) ও খিজর (আ.)-এর জ্ঞান অন্বেষণের যাত্রা এবং (৪) যুল-কারনাইনের ন্যায়বিচারমূলক শাসন।
এ চারটি কাহিনীর মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে দুনিয়াবী চার ফিতনার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার পন্থা—দ্বীন রক্ষা, সম্পদ-আভিজাত্যের ফিতনা, জ্ঞানের অহংকার, এবং রাজনীতি ও নেতৃত্বের পরীক্ষা।
তবে এর মধ্যে যে ফিতনার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সাবধান করেছেন, তা হলো দাজ্জালের ফিতনা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
مَنْ حَفِظَ عَشْرَ آيَاتٍ مِنْ أَوَّلِ سُورَةِ الْكَهْفِ عُصِمَ مِنَ الدَّجَّالِ
‘যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ রাখবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে।’
(মুসলিম, হাদিস: ৮০৯)
ফিতনার সময় যেন গাঢ় অন্ধকার। দাজ্জাল সেই অন্ধকারের প্রতীক, যে হক ও বাতিলকে গুলিয়ে দিতে চাইবে। তার সম্মোহনী ক্ষমতা, দুনিয়ার প্রাচুর্য ও বিভ্রান্তিকর অলৌকিকতা বহু মানুষকে সত্য থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। এই ভয়ানক বিভ্রান্তির সময়েই সূরা কাহাফ হবে ঈমানদারদের ঢাল, ঈমানদারদের জন্য এক আলোকবর্তিকা। যা দিয়ে সে সত্য ও সরল পথে অবচিল থাকার দিশা পাবে।
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যখন দাজ্জাল আসবে, তখন যারা সূরা কাহাফ পড়বে, তারা নিরাপদ থাকবে।’ এমন একটি দিনের জন্য প্রস্তুতি কি আমরা নিচ্ছি?
সুরা কাহাফ কোনো যাদুকরী শব্দ নয়; এটি এমন এক চেতনার ধারক, যা অন্তরকে জাগিয়ে তোলে, কোরআনের ভাষায় ভাবতে শেখায়, জীবনকে এক অনন্ত সত্যের দিকে এগিয়ে নেয়। সপ্তাহের ছুটির দিনটি যখন জুমা হয়ে আসে, যখন মসজিদগুলোয় খুতবার ধ্বনি ওঠে, তখন কি আমরা একবার থেমে সুরা কাহাফের আয়াতগুলো পড়ি? শুধু পাঠ নয়, তাদাব্বুর তথা অর্থ ও ব্যাখ্যার গভীরে ডুবে গিয়ে কী বার্তা আল্লাহ আমাদের দিচ্ছেন, তা বোঝার চেষ্টা করি?
আসুন, আমরা প্রত্যেক জুমায় সুরা কাহাফ পাঠকে অভ্যাসে পরিণত করি। শুধু ফজিলতের আশায় নয়; বরং নিজের ঈমানকে আলোয় ভরিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা থেকেই।
আলোকিত জীবন চাইলে আলোকিত সুরা কাহাফই সেই সুরা, যা নূর হয়ে জ্বলবে আপনার অন্তরে, আপনার সপ্তাহজুড়ে চলার পথে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন।