১০ মহররম কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনায় শোকাহত হয় পুরো মুসলিম বিশ্ব। ন্যায়ের পতাকাবাহী নবী বংশের প্রতি জানায় শ্রদ্ধা, সম্মান ও সমর্থন। আত্মত্যাগের মহিমা বর্ণনা করা হয় গান, কবিতা, গজল, কাওয়ালি ও মার্সিয়ায়। অসত্য ও অন্যায়ের প্রতিবাদে অবস্থান নেওয়ার প্রতীতি ঘোষণা করে প্রতিটি মুসলমান।
ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা হয় দক্ষিণ ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত কারবালার নৃশংস ঘটনা। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মৃত্যুর মাত্র ৫০-৬০ বছরের মধ্যেই তাঁর বংশ চরম অমানবিক অত্যাচারে ও একতরফা আক্রমণে প্রায় নির্বংশ হয়ে যায় কারবালায়। এ আঘাত বাইরে থেকে আসেনি; এসেছে ইসলামের নামধারী অনুসারী ক্ষমতালিপ্সু চক্রের পক্ষ থেকে। যারা পরবর্তী শত শত বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে রাখে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্ষমতায় থেকেও তারা ইতিহাসে স্থান পায়নি। ন্যায়ের পক্ষে লড়াই ও আত্মত্যাগ করে ঐতিহাসিক সম্মান লাভ করেছে নবী বংশ তথা আহলে বায়েতের সদস্যরা। যাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)। আর এজন্যই বলা হয়, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ/প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম নতুন করে জেগে ওঠে।
বহুল প্রচলিত এ পঙ্ক্তিতে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত পদক্ষেপের অনুপ্রেরণা নিয়ে বলা হয়েছে, যখনই অন্যায়-অবিচার বা জুলুমের বিরুদ্ধে কেউ সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগ করে, তখনই ইসলাম তার প্রকৃত রূপে জেগে ওঠে এবং পুনরুজ্জীবিত হয়। তাই কারবালা শুধু ইতিহাস নয়, এটি একটি আদর্শ-যেখান থেকে শিক্ষা নেওয়া হয় কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। আসলে কারবালায় ইমাম হোসাইনের (রা.) শাহাদাতের মধ্যেই নিহিত ছিল ইয়াজিদের মৃত্যু। বেঁচে থেকেও লাঞ্ছিত ছিল ইয়াজিদপন্থিরা। আর প্রতিটি কারবালার পরই ইসলামের নব উত্থান ঘটে সত্য পন্থিদের মাধ্যমে। ইমাম হোসাইন (রা.) যার নেতা হিসাবে প্রতিটি মুসলমানের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)সহ সর্বমোট ৭২ জন বীর শাহাদতবরণ করেছিলেন। ইমাম হোসাইন (রা.) যখন মক্কা ত্যাগ করে কারবালার পথে রওয়ানা হন তখন তার সঙ্গী-সাথীর সংখ্যা ছিল ৫০ জন। এদের মধ্যে নবী বংশের সদস্য ছিলেন ১৮ জন। বাকি ৩২ জন ছিলেন অন্যান্য বন্ধুবান্ধব, অনুসারী। ১০ মহররম তথা আশুরার দিন ইয়াজিদ বাহিনীর কিছুসংখ্যক সৈন্য নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ইমাম বাহিনীতে যোগ দেয়। উল্লেখ্য, ইমামের কাফেলার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন নারী ও শিশু। তিনি কারবালা পেরিয়ে কুফা নগরীতে যাচ্ছিলেন মানুষের আমন্ত্রণে। যেসব মানুষ দামেস্কে ক্ষমতাসীন ইয়াজিদের অত্যাচারে ছিল নির্যাতিত। যারা বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অন্য কোনো বংশ বা গোত্রের হাতে নয়, থাকতে হবে সত্য পন্থিদের হাতে। ইসলামে সবচেয়ে সত্য পন্থি হলো নবীর বংশ, যার নেতৃত্বে ছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল পূর্ববর্তী খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর মতো তার পুত্র ইমাম হোসাইন (রা.) খেলাফতে অধিষ্ঠিত হোন। কারণ তিনিই ছিলেন মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেওয়ার সবচেয়ে যোগ্য ও হকদার।
সত্যের পক্ষে ইমামের নেতৃত্বে জনতার মধ্যে ঐক্য হতে যাচ্ছে দেখে দামেস্কের ক্ষমতা দখলকারী ইয়াজিদ পক্ষ আতঙ্কিত হয়। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তারা শক্তি ও নির্মমতার মাধ্যমে জনগণকে অবনত করতে থাকে। এমনকি, ইমামের কাফেলায় হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে। তাদের অবরুদ্ধ করে পানির পিপাসা ও যন্ত্রণা দিতে থাকে এবং একতরফা হামলা চালায়। এতে তারা শহীন হন। ইমাম অনুসারী ৭২ জন শহীদের খণ্ডিত মস্তক ইয়াজিদের সেনাপতি ইবনে যিয়াদ কারবালা থেকে দামেস্কে পাঠায়। এভাবেই সত্য পন্থিদের ‘কতলে আম’ বা গণহত্যা করা হয়েছিল কারবালার প্রান্তরে।
এই হৃদয়বিদারক, শোকাবহ ঘটনার জন্য আশুরা বা ১০ মহররম মুসলিম উম্মাহর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে বারো মাসের মধ্যে রয়েছে পবিত্র চার মাস, যার একটি মহররম। ঐতিহাসিক নানা কারণেও মহররম গুরুত্বপূর্ণ। কারবালা ছাড়াও অতীতে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে মহররম মাসে। তদুপরি, মহররমকে আল্লাহর মাস বলা হয়েছে।
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হোসাইন (রা.)। কারবালা প্রান্তরে (৬০ বা ৬১ হিজরির ১০ মহররম) তার মর্মান্তিক শাহাদত ‘আশুরা’কে আরও গুরুত্বপূর্ণ করেছে। কারবালা ও কারবালাসংক্রান্ত ঘটনাগুলো ইসলামের ইতিহাসের জরুরি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এতে জানা যায়, ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রা.) চতুর্থ হিজরির শাবান মাসের ৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। আর ৬১ হিজরির ১০ মহররম আশুরার দিনে, যে দিনটি ছিল জুমার দিন, তিনি শহীদ হন। তাকে সিনান ইবনে আবি আনাস নাখায়ি হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করে খাওলি ইবনে ইয়াজিদ আসবাহি হিময়ারি। সে হোসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর মাথা শরীর থেকে দ্বিখণ্ডিত করে এবং ক্ষমতাসীনদের রাজদরবারে নিয়ে যায়। কারবালার প্রান্তরে পাপীষ্ঠরা যে নির্মমতা ও নির্দয়তার পরিচয় দিয়েছে, তা পাষণ্ড হৃদয়েও ব্যথা ও যাতনা সৃষ্টি করে। শাহাদতের পর হজরত হোসাইন (রা.)-এর দেহ মুবারকে মোট ৩৩টি বর্শা ও ৩৪টি তরবারির আঘাত দেখা যায়। শরীরে ছিল অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন।
খিলাফত ব্যবস্থার পুনর্জীবন করাই ছিল হোসাইন (রা.)-এর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন তিনি। সে পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী, ছেলে, বোন ও ঘনিষ্ঠ স্বল্পসংখ্যক অনুচর নিয়ে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কুফার উদ্দেশে রওয়ানা হন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে পৌঁছালে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাকে বাধা দেন। রক্তপাত ও খুনাখুনি বন্ধের উদ্দেশে হজরত হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব দেন : এক. তাকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক। দুই. তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেওয়া হোক। তিন. ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দামেস্কে পাঠানো হোক।
কিন্তু পাপীষ্ঠ ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তার কথার বিরুদ্ধাচরণ করে। সে ইমামকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেয়। হজরত হোসাইন (রা.) ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এজন্য নবী বংশের সদস্যদের অমানবিক কষ্ট দেওয়া হয়। ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী পরিবারের নারী ও শিশুদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। তারা ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। ইমামের কাফেলায় পানির হাহাকার শুরু হয়। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করতে আসিনি। এমনকি ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়। খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার আমার কাম্য।’
কিন্তু এরপরও ইয়াজিদ বাহিনী ১০ মহররম নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক অসম যুদ্ধে, কিংবা বলা ভালো যুদ্ধের নামে একতরফা আক্রমণ ও গণহত্যায় ইমামের পুত্র তথা নবী বংশের একমাত্র উত্তরাধিকার হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া ৭০ থেকে ৭২ জন শহীদ হন। ইমাস হোসাইন (রা.) মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যায় পন্থিদের কাছে আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য স্বীকার করেননি। বরং তিনি জীবন দিয়ে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন।
এ ঘটনা শুধু আরব বিশ্বেই নয়, সারা মুসলিম জাহানেই তীব্র আলোড়ন তৈরি করে। এ উপমহাদেশের মুসলমানরাও উদ্বেলিত হয় শোকে ও প্রতিবাদে। কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘কাতলে হুসাইন আসল মে মর্গে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারাবালা কি বা’দ।’ মূলত কারবালায় ইমাম হোসাইনের শাহাদতের মধ্যেই নিহিত ছিল ইয়াজিদের মৃত্যু, আর প্রতিটি কারবালার পরই ইসলামের নব উত্থান ঘটে।
কিন্তু কারবালার ঘটনায় শোকের আর্তি প্রকাশ করলেও মুসলিম জাহান থেকে কি দুর্নীতি, অন্যায়, শোষণ, বঞ্চনার অবসান হয়েছে? ইমাম হোসাইনের জীবনদানের চেতনায় মুসলিম উম্মাহ সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছে? নাকি বিশ্বের দেশে দেশে আপস ও আত্মসমর্থন করে মুসলিম শাসকবর্গ নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতা রক্ষা করছেন। আর মুসলমানরা আত্মস্বার্থে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
এসব প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। বস্তুতপক্ষে, মুসলিম নেতৃত্ব ও উম্মাহ স্বার্থ ও শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য গাজায় প্রতি মিনিটে একজন মানুষ, নারী কিংবা শিশুকে হত্যা করতে পারছে আগ্রাসী ইসরাইল। বিশ্বে যত সংঘাত ও গৃহযুদ্ধ চলছে, আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত যত হানাহানি-এসব ঘটনার মূল শিকার এখন মুসলিম জনগোষ্ঠী। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থী হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও দরিদ্র হলো মুসলিমরা। বিশ্বের দেশে দেশে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও শোষিত হচ্ছে মুসলিম সংখ্যালঘুরা।
মুসলিমরা যেসব দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে তারা ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশে লিপ্ত। নিজের স্বার্থ ও সুখ ছাড়া অন্য কোনো দিকে তারা তাকিয়েও দেখে না। পক্ষান্তরে যেসব দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানে তাদের প্রতিনিয়ত নিপীড়ন ও নির্মমতার শিকার হতে হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আগ্রাসী শক্তির হামলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারাচ্ছে ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুসলিমরাই। এমন দুর্দশার পরিস্থিতিতে ১০ মহররমের ঘটনায় শোকাহত হওয়ার পাশাপাশি নবী বংশ তথা ইমামের ত্যাগ ও সংগ্রামের চেতনায় ঋদ্ধ হওয়ারও দরকার আছে। ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আছে। পীড়িত ও বিপন্ন মানুষকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসার কর্তব্যও রয়েছে। যতদিন পর্যন্ত মুসলিম জনতা, বিশেষ করে তাদের নেতৃত্ব এসব জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কাজ না করবে, ততদিন লাঞ্ছিত ও অবদমিত থাকতেই হবে। নবী বংশ ও ইমামের জন্য শোকের পাশাপাশি তাদের চেতনা তথা শিক্ষা-দীক্ষা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে মুসলিম জাহানে অন্ধকারের প্রহর কেটে আলোর উদ্ভাস সম্ভব হবে।
প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ : চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়