একজন ক্রিকেটারের কাছে ক্রিকেটের চাইতে বড় আর কীইবা হতে পারে? উঁহু, ভুল ভাবছেন। নিজের দেশ যে সবার আগে। আর সে কারণেই ক্রিকেট আর দেশ দুয়ের মধ্যে দেশকেই বেছে নিয়েছিলেন। তার দেশ তখন কারগিলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে ভারতের সঙ্গে, সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। সে ঘটনার ঠিক আগে নটিংহ্যামশায়ার তাকে প্রায় পৌনে দুই লাখ পাউন্ডের চুক্তি প্রস্তাব করেছিল, সেটাকেও তিনি পায়ে ঠেলে দেন।
১৯৭৫ সালের আজকের এই দিনে জন্ম, তার। সেই শোয়েব আখতার সম্পর্কে অনেক গল্পই আপনি জানেন। তবে এই গল্পটা হয়তো আপনি জানতেন না। শোয়েব ছিলেন এমনই, পরতে পরতে ছিল রহস্য। গোটা ক্রিকেটে খোঁজ করলে এমন চরিত্র আপনি খুঁজে পাবেন কমই। আর সে কারণেই ক্রিকেট তাকে মনে রেখেছে আলাদাভাবে।
‘নষ্ট প্রতিভা’ ক্রিকেটে আছে বেশুমার। তাকে অনেকে সে খাতাতেই ফেলে দিতে চান। তার ক্যারিয়ার ভরা ছিল নানা বিতর্ক, শৃঙ্খলাভঙ্গ, চোট আর নিষেধাজ্ঞায়। তবুও, মাঠে যখন তিনি ছুটে আসতেন, তার গতি, স্টাইল আর ভয়ংকর ইয়র্কার দেখার জন্য দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ত।
তার অর্জনের খাতা যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন সেখানে তেমন কিছুই নেই। তার সময়ে পাকিস্তান একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে, তবে সে সময় তিনি ছিলেন দলের বাইরে। তার আগে এশিয়া কাপ জিতেছে তার দল, সেখানেও তিনি ছিলেন না। ফলে ক্যারিয়ারটা মেজর কোনো ট্রফি জেতা ছাড়াই শেষ করেছিলেন তিনি। তবে শোয়েবকে কি শুধু উইকেট, আর ট্রফি দিয়ে মাপা সম্ভব? হয়তো নয়!
১৯৯৯ সালের শুরুর দিকের কথা। পাকিস্তান আছে ভারত সফরে, এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ খেলতে। ঠিক তখন রথী মহারথীদের পেছনে ফেলে আলো কেড়ে নিলেন এক ২৪ বছর বয়সী ছোকড়া। কেন, তার জবাবটা তিনি দিলেন কিছুক্ষণ পর। টানা দুই বলে ফেরালেন রাহুল দ্রাবিড় আর শচীন টেন্ডুলকারকে। শচীন তার ক্যারিয়ারে এর আগ পর্যন্ত প্রথম বলে আউট হয়েছিলেন মোটে একবার। শোয়েব তাকে উপহার দিলেন দ্বিতীয়টা।
শোয়েব তার ক্যারিয়ারে বড় মঞ্চে এভাবে জ্বলে ওঠার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বহুবার। সে বছর বিশ্বকাপের কথাই মনে করুন। ১৬ উইকেট নিয়ে তিনি ছিলেন দলের দ্বিতীয় সেরা বোলার, সে বিশ্বকাপে তার চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছিলেন মোটে ৫ জন। পাকিস্তান যে ফাইনাল খেলল, তাতে বিশাল অবদান তো তারও ছিল!
কিংবা বছর দুই পরে? যখন লাহোরের পাটা উইকেটে গতির ঝড়টা তুললেন? ইনজামামের ৩২৯ রানের অতিমানবীয় ইনিংসের পর তিনি ৮.২ ওভারে তুলে নিলেন নিউজিল্যান্ডের ৬ উইকেট। আর তাতেই ৭৩ রানে অলআউট হলো সফরকারীরা। পাকিস্তানের ইনিংস ব্যবধানে জয়ের ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় ইনজামামই ছিলেন। তবে লাহোরের ওই ব্যাটিং স্বর্গে কিউই ব্যাটিং লাইন আপকে গুঁড়িয়ে জয় তুলে নেওয়ার অসাধ্যটা করেছিলেন আসলে শোয়েবই।
তিনি তার ক্যারিয়ারজুড়েই এমন সব অসাধ্য সাধন করে গেছেন। শোয়েব যখন ক্রিকেটে এলেন, তখনই টিভিতে বলের গতি মাপা শুরু হয়েছিল। তার গতি ১৫০ ছুঁত হরহামেশাই। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে গতিময় বোলারটা তিনি হবেন, ভাঙবেন ১০০ মাইলের ব্যারিয়ারটা, এটা বোধ হয় একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শোয়েব মনে পুষে রেখেছিলেন সে স্বপ্নটা, তিনি বনেও গিয়েছিলেন ১০০ মাইল গতিতে বল করা প্রথম বোলার।
দারুণ গতি আছে যা বয়সের সাথে সাথে স্রেফ বেড়েছেই। সঙ্গে যখন বড় মঞ্চে জ্বলে ওঠার সহজাত ক্ষমতাটাকে যোগ করবেন, তখন তা আধুনিক যুগের ক্রিকেট গ্রেট হওয়ার চিত্রনাট্য না লিখেই পারে না। এখান থেকে এমনটা না হওয়াটাই অসাধ্য ছিল।
পুরো ক্যারিয়ারে অসাধ্য সাধন করা শোয়েব সে অসাধ্যটাও সাধন করেই বসলেন। ক্রিকেটকে তিনি দিতে পারলেন তার সামর্থ্যের সামান্যই।
গতি তারকাদের ক্যারিয়ারের একটা বড় শত্রুর নাম– চোট। শোয়েবেরও তা ছিল। এতটাই যে একটা সময় তাকে সকালে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হতো ওয়াশরুমে।
তবে এটাই শোয়েবের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল না। সেসব সামলেও তো দিব্যি খেলে গেছেন একটা বড় সময়। শোয়েবের পথ মূলত আগলে দাঁড়িয়েছিল তার নিয়ম মানায় তীব্র অনীহা। দিনদুয়েক পরপর অক্রিকেটীয় কারণে শিরোনামে না এলে বুঝি রাতের ঘুমটাও ঠিকঠাক হতো না তার। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে সতীর্থকে পিটিয়ে নিষিদ্ধ হওয়া, ড্রাগ টেস্টে ফেল মেরে নিষিদ্ধ হওয়াসহ কত বিচিত্র কারণে যে ক্রিকেট থেকে বাইরে চলে গেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ক্যারিয়ারটাও খুব বেশি সমৃদ্ধ হয়নি তাই। ট্রফি তো নয়ই
ক্যারিয়ার খুব বেশি বড় নয়, ট্রফিও নেই নামের পাশে। তবু পাকিস্তানের ক্রিকেট নিয়ে একটা সময় আলাপ যখন হতো, শোয়েবের নামও উঠতো সমানভাবেই। কেন? সে প্রশ্নের জবাবটা একটু বিশদভাবেই দেওয়া প্রয়োজন বোধ করি।
আজকালকার যুগে পাকিস্তানের সে চরিত্রটা এখন আর নেই। তবে চলতি শতাব্দির শুরুর দিকে দলটার ডাকনামই ছিল ‘দ্য আনপ্রেডিক্ট্যাবলস’; কখন কী করে বসে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সে কারণে দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে পাকিস্তানের ভক্তের সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিল না।
কি? বৈশিষ্ট্যটা চেনা মনে হচ্ছে না? শোয়েব যেমন স্বভাবের ছিলেন, তা পাকিস্তানের ওই অননুমেয় চরিত্রকে তুলে ধরত খুব দারুণভাবে। বিধ্বংসী স্পেলে যেমন প্রতিপক্ষকে চোখের পলকে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন, ঠিক তেমনি আত্মঘাতী কোনো কাজ করে নিষিদ্ধও হয়ে যেতে পারেন… শোয়েব ছিলেন এমনই, নিখাদ ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ এর বিশুদ্ধ এক প্যাকেজ।
উইকেট, ট্রফি… ইত্যাদি ক্রিকেটীয় পুঁজিবাদী বিষয়আশয় একপাশে রেখে শোয়েব আখতার তাই ক্রিকেটে আলাদা জায়গা করেই রয়ে গেছেন। বোধ করি থাকবেন আরও বহু বছর।