ব্যক্ত হবে ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থা ভাঙার অঙ্গীকার * গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকাকে বড় করে দেখানো হবে * আ.লীগের নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুন-ধর্ষণ ও জুলাই গণহত্যার তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে
ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার দৃপ্ত প্রত্যয়ে শপথ নেবেন ছাত্র-জনতা। আজ রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন দলমতের নেতাকর্মীরা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। তবে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এদিন জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি সরকারের এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে না নিজেদের মতো করে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবে তা চূড়ান্ত হয়নি। সোমবার রাতে বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বৈঠকে বসেন। রাত সাড়ে ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক শেষ হয়নি। তবে সূত্র জানিয়েছে, আজ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগের সিদ্ধান্ত ছিল আজ প্রকাশ করা হবে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’। বেলা ৩টায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ঘোষণাপত্রে ২৯টি ধারা থাকছে। ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার দীপ্ত প্রত্যয়ে শপথ নেবেন ছাত্র-জনতা। ইতোমধ্যেই আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে সারা দেশ থেকে আগত ছাত্র-জনতাকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। অনুষ্ঠানস্থলেই প্রদর্শিত হবে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের দ্বারা পরিচালিত নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুন-ধর্ষণ, দুর্নীতি ও লুটপাট এবং জুলাই গণহত্যার শীর্ষক তথ্যচিত্র। এর পাশাপাশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকাকে বড় করে দেখানো হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের দালিলিক ভিত্তি, লেজিটেমিসি এবং নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। এ ঘোষণার মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে এবং বর্তমান সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। ঘোষণা মঞ্চে রাজনৈতিক কোনো দলের নেতারা থাকবেন না। মঞ্চে থাকবেন জুলাই অভ্যুত্থানের শহিদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিরা। তাদের সঙ্গে থাকবেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫৮ জন সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়ক। এছাড়াও ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষাবিদসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত থাকবেন। সরকারের উপদেষ্টারাও উপস্থিত থাকতে পারেন। ঘোষণাপত্রটি কে পাঠ করবেন, সে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। তবে আন্দোলনের সময় স্বৈরাচার পতনের একদফার ঘোষক তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম কিংবা শহিদ পরিবারের সদস্য কিংবা আহত কোনো ছাত্র এ ঘোষণা দিতে পারেন। ৩১ ডিসেম্বর এই ঘোষণাপত্র এলেও তা ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের এই ঘোষণাপত্রে মোট ২৯টি ধারা থাকছে। ঘোষণাপত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীনতা, ভারতবর্ষ ভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য, স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক অবক্ষয়, ৭২ সালের সংবিধানে লাখ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের প্রতিফলন না হওয়া, সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব, কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেন বন্দোবস্ত ও মুজিববাদী দৃষ্টান্তকে স্থায়ীকরণ, শেখ হাসিনার প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ প্রশস্তকরণ, একাত্তরের চেতনাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে বিগত সরকারের মুজিববাদ ও ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ জিইয়ে রাখা; সামরিক, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ; দুর্নীতি এবং দমনমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার হাতিয়ারকরণ; সংখ্যালঘু এবং নারীদের ফ্যাসিবাদী শাসনের লক্ষ্যে পরিণত করা, সাড়ে ১৫ বছরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ ও বৈষম্য; রাজনৈতিক কারণে বলপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জেল-জুলুম, পিলখানা ষড়যন্ত্র, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড, প্রহসনমূলক বিচারব্যবস্থা, বাংলাদেশপন্থি অবস্থানের জন্য ভারত বিরোধীদের মারধর, শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা পাচার, ন্যায্য দাবি তুললে শ্রমিকদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা, ক্যাম্পাসগুলোতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হাতে শিক্ষার্থী ও তরুণদের নির্যাতন, জুলাই বিপ্লবে সরকারের নৃশংস বলপ্রয়োগ ও ছাত্র হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হবে।
এই ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-মর্যাদা, সাম্য, ন্যায়বিচার পুনরুদ্ধার করা; সংসদ এবং হাসিনার শাসন দ্বারা মনোনীত বা নির্বাচিত সব দপ্তর ভেঙে দেওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরা হবে। ৭২-এর সংবিধানের সংস্কার বা বাতিল চাওয়া হবে।
গত ১৫ বছরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভিন্নমত দমন, পিলখানা ও শাপলা হত্যাকাণ্ড, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ, জনগণের ভোটাধিকার হরণসহ নানামুখী অপরাধে যুক্ত থাকায় জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে। এ ঘোষণার মাধ্যমে মূলত বর্তমান ‘মুজিববাদী সংবিধান’কে অপ্রাসঙ্গিক করা হবে। ঘোষণাপত্রে নতুন বাংলাদেশের জন-আকাঙ্ক্ষার কথাও উঠে আসবে। মূলত বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে প্রকাশ পেতে যাচ্ছে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র। লাখো ছাত্র-জনতা এতে অংশগ্রহণ করবেন।
ছাত্র প্রতিনিধিরা বলছেন, রক্ত দিয়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান রক্ষায় আজকের আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করবেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে এখানে শপথ নেবেন তারা। আগতদের পদচারণায় ৫ আগস্টের মতো শহিদ মিনার চত্বরে উৎসবের আমেজ তৈরি হবে বলে তাদের বিশ্বাস।
জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন যুগান্তরকে বলেন, যেভাবে ৫ আগস্ট রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। মানুষ যেভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঠিকই একইভাবে কাল (আজ মঙ্গলবার) জাতীয় শহিদ মিনারে মানুষের ঢল নামবে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করবেন। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লব ঘোষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে সারা দেশে থেকে মানুষ আসবেন। অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং নির্দেশনা চাচ্ছেন। তবে কত মানুষ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন, এই মুহূর্তে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, কত মানুষ আসবে সেটার সংখ্যাটা বলা কঠিন। ৩১ জুলাই (আজ) শহিদ মিনারে যে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল-এটি সেটাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। তিনি বলেন, আমাদের কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। আমাদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এখনে কে আসবেন কিংবা আসবেন না, এটা একান্তই তাদের ব্যাপার। এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না।
সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ : ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যেই বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। দলগুলোর সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে গত ১৫ বছরের নির্বিচারে খুন, গুম, গণহত্যা, ভোট চুরি, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আওয়ামী লীগ ও দলটির জোট শরিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ডিএমপির ট্রাফিক নির্দেশনা : আজ শহিদ মিনারের এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ট্রাফিক নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে-গাবতলী হয়ে ঢাকা মহানগরে প্রবেশকৃত যানবাহনগুলো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আগারগাঁও এলাকার পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে পার্কিং করবে; সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী প্রবেশপথ দিয়ে আগত যানবাহনগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় পার্কিং করবে এবং আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রবেশকৃত যানবাহনগুলো ৩০০ ফিট এলাকায় পার্কিং করবে।